রংপুর নিউজঃ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবন তিন দিন ধরে অবরুদ্ধ। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে গতকাল শনিবারও হাজার হাজার মানুষ নগর ভবন ঘেরাও করেন। সকালে নগর ভবনের সব ফটকে তালা দিয়ে সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেন তারা। এ সময় ওই ভবনে থাকা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীও কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। আন্দোলনকারীরা এ দু’জনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাদের প্রতিহত করার হুঁশিয়ারি দেন। আজ রোববারও নগর ভবন অবরুদ্ধ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
এ পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ইশরাক হোসেন বলেছেন, ‘আমাকে মেয়র পদে বসানোর জন্য এটা নগরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা নেই। আমি নিজেও মেয়র হিসেবে শপথ নিতে প্রস্তুত। তবে সরকার এ নিয়ে গড়িমসি করছে। ঢাকাবাসী এটা মেনে নেবে না।’
২০২০ সালে ডিএসসিসি নির্বাচনে হারলে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। গত ২৭ মার্চ আদালত তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) গেজেট প্রকাশ করে। এরপর ইশরাকের শপথ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। পরে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে শপথ কার্যক্রম ঝুলে যায়। এ নিয়ে আজ রোববার আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
২০২০ সালের ২ জুন ডিএসসিসির দ্বিতীয় পর্ষদের প্রথম বোর্ড সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য মেয়র পদে থাকার বিধান রয়েছে। সে হিসাবে আগামী ২ জুন দ্বিতীয় পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে শপথ নিতে না পারলে ইশরাকের আর ডিএসসিসির মেয়র হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এ জন্যই ইশরাকের ইশারায় তাঁর অনুসারীরা জোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে চাউর রয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে মেয়র-কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বরখাস্ত মানেই পর্ষদেরও বিলুপ্তি। তবে এখন বিষয়টি চলছে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ফলে যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সেটা নগরবাসীর। কারণ, দিনের পর দিন নগর ভবন অবরুদ্ধ থাকার কারণে নাগরিকরা যে কত ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখন দেখা যাক, আদালত কী রায় দেন।
ইশরাককে মেয়র পদে না বসানোর প্রতিবাদে ‘আমরা ঢাকাবাসী’র ব্যানারে গতকাল সকালেই কয়েক হাজার মানুষ নগর ভবনের সামনে জমায়েত হয়ে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেন। লংমার্চটি জিরো পয়েন্ট হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে শিক্ষা ভবন ঘুরে আবার নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভকারীরা ‘আসিফের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘শপথ নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘অবিলম্বে ইশরাকের শপথ চাই, দিতে হবে’, ‘জনতার মেয়র ইশরাক ভাই, অন্য কোনো মেয়র নাই’– এমন নানা স্লোগান দিতে থাকেন। সাবেক সিনিয়র সচিব মসিউর রহমানের নেতৃত্বে গত বুধবার থেকে এ আন্দোলন চলছে। গতকাল এ কর্মসূচিতে ডিএসসিসির সাধারণ কর্মচারীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেন।
যাত্রাবাড়ী থেকে আসা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট পাস হলেও তাঁকে শপথ পড়ানো হচ্ছে না। অবিলম্বে তাঁকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আমরা সচিবালয় ঘেরাও করতে এসেছি।’ পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যদি ইশরাককে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া হয়, আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’
গত ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ডিএসসিসি নগর ভবনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে। এ ভবনেরই ১৪তলায় বসেন উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া। গত বুধবার থেকে তিনিও নগর ভবনে ঢুকতে পারছেন না। গতকাল সমাবেশ থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সাবেক সিনিয়র সচিব মশিউর রহমান হুঁশিয়ারি দেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করা হবে।
গত বুধবার থেকেই নগর ভবন কার্যত অবরুদ্ধ। বৃহস্পতিবার প্রধান ফটকগুলোতে তালা লাগানো হলেও গতকাল সবক’টি ফটকসহ সিঁড়িতে ৬৫টি তালা ঝোলানো হয়। সব লিফট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কেউই নগর ভবনে ঢুকতে পারেননি। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একই অবস্থা। অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছু কার্যক্রম চলছে সচিবালয়ের পুরোনো ভবনে। নগর ভবনের কর্মকর্তারা কয়েক দিন ধরে সেখানেই সময় কাটাচ্ছেন। এ ছাড়া ডিএসসিসি নগর ভবনে সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছাড়াও দুটি আঞ্চলিক দপ্তরের কার্যক্রম বন্ধ। এ ভবনে থাকা আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্পেরও কেউ ঢুকতে পারছেন না।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাসেল রহমান সমকালকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকেই নগর ভবনের কার্যক্রম মূলত বন্ধ। তাদের আনা-নেওয়ার গাড়িও ভবন থেকে বের হতে পারছে না।’
এদিকে নগর ভবন অবরুদ্ধের ঘটনায় সিটি করপোরেশনের ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী, প্রকৌশল, রাজস্ব আর ভান্ডার দপ্তরসহ সব বিভাগীয় দপ্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্যান্য আঞ্চলিক ৮টি দপ্তর আর ৭৫টি ওয়ার্ড অফিস। এ ছাড়া নগর ভবনে থাকা অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৪ এর সব সেবাই বন্ধ। দুপুরে জন্মসনদের জন্য রাজধানীর কলতাবাজারের পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন নগর ভবনে। তিনি বলেন, ‘ছেলের পাসপোর্টের জন্য জন্মসনদের প্রয়োজন। এ জন্য নগর ভবনে এসেছিলাম। তবে এসে দেখি গেটে তালা।’
সেগুনবাগিচার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম জানান, তাঁর বাসার হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের জন্য তিনি নগর ভবনে গিয়েছিলেন। এভাবে গত দু’দিন তিনি ফিরে গেছেন।
সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মেয়রের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সরকার নানাভাবে কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও শপথ নিতে ইচ্ছা করে দেরি করা হচ্ছে। আমি শপথ নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইনি পদক্ষেপ নিয়েই গেজেট প্রকাশ করেছে। তবে গেজেট প্রকাশের ২০ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত শপথের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেটা সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় বিভাগের এখতিয়ারে পড়ে।’
তিনি বলেন, বলা হচ্ছে, আমরা নাকি অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি ঘৃণাভরে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা যথাসময়ে এই বিষয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলাম। ১৮০ দিনের মধ্যে আপিল করলেও অবৈধভাবে নির্বাচিত মেয়র তাপস সাহেব প্রভাব খাটিয়ে এ বিষয়ে আদালতকে কিছু করতে দেননি। আর তখন আদালতও ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের দখলে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালত। একই রায়ে চসিক নির্বাচন বাতিল চেয়ে বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের করা মামলায় তাঁকে মেয়র ঘোষণা করেন আদালত। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর আদালত এ রায় দিয়েছিলেন।
ওই সময় বাদীপক্ষের অ্যাডভোকেট আরশাদ হোসেন আসাদ বলেছিলেন, চসিক নির্বাচন বাতিল চেয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন মামলা করেছিলেন। বাতিল চেয়ে মামলার পর ওই সময় আমরা আরজি সংশোধনের আবেদন করেছিলাম। তখন আদালত করেনি। ৫ আগস্টের পর আরজি সংশোধনের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন আদালত। তারপর শুনানি শেষে ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন আদালত।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চসিক নির্বাচনে কারচুপি ও ফল বাতিল চেয়ে ডা. শাহাদাত প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।