অনিল চন্দ্র রায়, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি :
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুরাণ বা মা মনসামঙ্গল গানের আসর ফিরিয়ে আনলো কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার গোরকমন্ডল গ্রামে। পাঁচদিনব্যাপী এ আয়োজনে হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশুকিশোর অংশগ্রহণ করে উপভোগ করেছে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক অনন্য গীতিনাট্য।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল এলাকার বাসিন্দা মনিন্দ্র চন্দ্র মন্ডলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠান শুরু হয় ২৩ জুলাই এবং শেষ হয় ২৭ জুলাই রাতে। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার দহগ্রাম এলাকা থেকে আগত শিল্পী কৈলাশ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি দল গীতিনাট্য পরিবেশন করেন। বেহুলা-লখীন্দর, শিব-পার্বতী ও সৃষ্টিপত্তনের মতো গাথা ছিল এ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ।
ভাসান গানের আয়োজক মনিন্দ্র চন্দ্র মন্ডল জানান, এটি তাঁর একটি মানতের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়। শিল্পীদের ৩৩ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ করা হয় এবং প্রতিদিন সন্ধ্যা ৫টা থেকে রাত ১-২টা পর্যন্ত চলে এই পালাগান।
মূল শিল্পী কৈলাশ চন্দ্র রায় বলেন, “ভাসান মূলত বেহুলা-লখীন্দরের গীতিনাট্য। আগে এসব অনুষ্ঠান মাঠে ফসল তোলার পর অনুষ্ঠিত হতো। এখন খুব কম হয়। নামও এলাকা ভেদে ভিন্ন—বিষহরি, পদ্মপুরাণ, বেহুলার নাচাড়ি, কান্দনী বিষহরি ইত্যাদি নামে পরিচিত। আমাদের অঞ্চলে একে পদ্মপুরাণ গান বলা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই পেশায় আমি ২৪ বছর ধরে যুক্ত। কিন্তু ব্যয়বহুল ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় এখন অনেকেই এগিয়ে আসেন না। কিছু ধর্ণাঢ্য পরিবার এখনো উদ্যোগ নেয় বলে টিকে আছে।”
শিল্পীরা জানান, প্রতিটি পালার জন্য পোশাক পরিবর্তন, নাট্যরূপ ও গানের আবহ তৈরি করতে অর্থ ও শ্রম লাগে। অভিনয় শিল্পী কমল চন্দ্র রায়, পুষ্প চন্দ্র বর্মন, মনি শংকর রায়, অন্তর চন্দ্র বর্মন ও সুমন চন্দ্র বর্মন বলেন, “এই পেশা দিয়ে সংসার চলে না। তারপরও ভালোবাসার টানেই আমরা ১০-১৫ বছর ধরে করে যাচ্ছি।”
এ আয়োজনে উপস্থিত হয়ে নাগেশ্বরী থেকে আগত দর্শক শারতী রায় ও লালমনিরহাট থেকে আগত শিল্পী রানী বলেন, “শৈশবে এসব পালা দেখেছি। আজ এত বছর পর দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।”
স্থানীয় ইউপি সদস্য শ্যামল চন্দ্র মন্ডল বলেন, “ছোটবেলায় এমন গান দেখে মুগ্ধ হতাম। আজও মনে আছে কুশান, পদ্মপুরাণ, বিষহরি এসব গানের কথা। এ আয়োজন নতুন প্রজন্মকে আমাদের শেকড়ের সঙ্গে পরিচিত করাবে।”
প্রধান শিক্ষক আলম মিয়া বলেন, “এই আয়োজনের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই সাংস্কৃতিক ধারা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।”
পাঁচদিনের এই গীতিনাট্যের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির যে পুনর্জাগরণ ঘটেছে, তা নতুন করে ভাবতে শেখায়—আমাদের শেকড়, আমাদের পরিচয়, আমাদের লোকজ ঐতিহ্য কীভাবে ধরে রাখতে পারি।