ইকবাল বাহার, পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ
দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, ভয়ভীতি, সম্পদের পাহাড় আর একক আধিপত্যের অভিযোগের মুখে থাকা পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের কোশাধ্যক্ষ মোশারফ হোসেনকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিকেলে সদর উপজেলার জালাসী এলাকায় একটি পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ হিল জামানের দিকনির্দেশনায় এসআই মানিক উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল মোশারফ হোসেনকে আটক করে। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
স্থানীয়রা তাকে ‘জালাসীর সম্রাট’ বলে ডাকতেন—কিন্তু সে নাম সম্মানের নয়, বরং আতঙ্কের। মোশারফ হোসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হলেও গত এক দশকে নিজেকে রাজনীতির আড়ালে অপরাধ সাম্রাজ্যের সম্রাটে পরিণত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জালাসী বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে তার প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, কেউ তার ‘অনুমতি’ ছাড়া ব্যবসা করতে পারত না। সাধারণ মানুষ, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পেতেন।
একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, “আমরা চোখের সামনে দেখেছি কীভাবে নিরীহ মানুষদের জমি দখল করা হয়েছে। এলাকার যুবকদের অনেককেই তিনি টেন্ডার বা সিন্ডিকেট ব্যবসায় ব্যবহার করেছেন।”
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মোশারফ হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে— সরকারি টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডার বাণিজ্য, জমি দখল, ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলা, চাঁদাবাজি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগ।
বিশেষ করে গত কয়েক বছরে তার বিরুদ্ধে জমি দখল ও প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ বেশ দৃঢ় হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন ওঠে, দীর্ঘদিন ধরে এতসব অভিযোগের পরেও কেন তাকে আইনের আওতায় আনা যায়নি?
স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মতে, মোশারফ হোসেন দলীয় পদে থাকায় এবং ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়া থাকার কারণে প্রশাসনের অনেকে তাকে ছুঁতে সাহস পায়নি। দলের ভেতরেও অনেক নেতাকর্মী তার সঙ্গে সুবিধাবাদী সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছিলেন।
একজন আওয়ামী লীগ নেতার মন্তব্য, “আমরা দলের সম্মান রক্ষার জন্য অনেক সময় চুপ থাকতাম। কিন্তু মোশারফ যা করেছে, তাতে দলই লজ্জিত হয়েছে। তার মতো লোকের জায়গা রাজনীতিতে হতে পারে না।
স্থানীয় এক চা দোকানি বলেন, “এমন লোকদের ধরলে আমরা সাধারণ মানুষ একটু শান্তিতে থাকতে পারি। এখন আশা করছি তার সহযোগী আর প্রভাবশালীরাও ধরা পড়বে।”
তবে অনেকেই বলছেন, মোশারফ হোসেন একজন ব্যক্তি হলেও, তার পেছনে রয়েছে গোটা একটি শক্তিশালী চক্র। তাকে বিচারের আওতায় আনা যেমন জরুরি, তেমনি তার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়াও সময়ের দাবি।
গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তির নিশ্বাস বইতে শুরু করে। অনেকেই প্রকাশ্যে পুলিশের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
মোশারফ হোসেনের গ্রেপ্তার একটি বড় পদক্ষেপ হলেও এটি যেন একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়, এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন নাগরিকদের।
সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ হিল জামান বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছিলাম। অবশেষে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে থানায় এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”