হাবিবুর রহমান, পীরগাছা (রংপুর) প্রতিনিধিঃ
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার শল্লার বিল আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের পর অভিযোগ তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) দুপুরে উপজেলার শল্লার বিল আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে দুদকের একটি টিম। এ সময় স্থানীয় লোকজন নানা অভিযোগ তুলে ধরে।
দুদক রংপুরের সহকারী পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এই অভিযান পরিচালনা করে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর উপ-সহকারী পরিচালক জয়ন্ত সাহা ও কোর্ট পরিদর্শক মো. হোসেন আলী।
অভিযানের পর বেলাল হোসেন বলেন, আমরা মূলত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত করছি। আমরা এখানে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। তবে একদিনেই পুরো তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়।
এ সময় স্থানীয় ভূমিহীনরা দুদক কর্মকর্তাদের কাছে প্রকাশ্যে অভিযোগ জানান,তারা বলেন, তাদের কাছ টাকা চাওয়া হয়েছিল, যারা টাকা দিতে পারেনি তাদেরকে ঘর দেওয়া হয়নি। স্থানীয় ভূমিহীনদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন এলাকার বিত্তবানদের নিকট অর্থের বিনিময়ে ঘর দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার (২৮ জুন) ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে হরিলুট’ শিরোনামে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।এর পরেই তদন্ত শুরু করেন দুদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের শল্লার বিলে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৪৩০টি ঘর নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুরু থেকে সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) নাজমুল হক সুমনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। গত ৫ আগস্টের পরেও আওয়ামী লীগের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত নাজমুল হক সুমন সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অনিয়ম চালিয়ে যান। এতে তাকে সহযোগিতা করেন অন্নদানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান সংগ্রাম।
তার মাধ্যমে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে নাগরিক সুবিধা ছাড়াই শল্লারবিলে দায়সারা ভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৩০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। পুনর্বাসিতদের জন্য নাগরিক সেবা কমিউনিটি সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ-মন্দির ও কবরস্থান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মক্তব, খেলার মাঠ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তাসহ কিছুই নেই।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় ৪৩০টি ঘর নির্মাণের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে পীরগাছায়। প্রতি ঘর তৈরিতে বরাদ্দ হয় ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা। প্রথম অবস্থায় ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। ২০২৪ সালের শেষের দিকে বাকি ৩২০টি ঘর নির্মাণ শুরু হয়। প্রতিঘর থেকে নিম্নমানের কাজের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ টাকা করে মোট ৪ কোটি ৩০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পটির ৩২০টি ঘর নির্মাণকাজ শুরুর আগে সেখানে ৫-৬ ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৫৬৬ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাবিখা প্রকল্পে শ্রমিক দিয়ে মাটি ভরাটের নিয়ম থাকলেও করা হয়েছে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে। তবে দেড় থেকে তিন ফুট উঁচু করা হয়েছে। যা বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনোভাবেই ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। এর পরেও তারা আশ্রয়ণ প্রকল্পকে ঝুঁকিতে ফেলে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছেন। এতে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রকল্পস্থলে ড্রেজার মেশিন দিয়ে গভীর খনন করে অতিরিক্ত মাটি কেটে জমিয়ে রাখা হয়। পরে প্রায় ৪ কোটি টাকার মাটি বাইরে বিক্রি করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভাঙন কাছাকাছি চলে এসেছে।
এরই মধ্যে তাসনিম ও কহিনুর বেগমসহ চারজন মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদেরকে প্রকল্প সীমানার বাইরে দাপন করা হয়েছে। অনেকের কবুলিয়ত সম্পাদন হয়নি, ভিজিএফ প্রদান করার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষবিশিষ্ট সেমিপাকা একক ঘর নেই। প্রকল্পটিতে করা হয়েছে বহুমুখী অনিয়মের মাধ্যমে। পানীয়জলের সমস্যায় ভুগছে আশ্রিতরা। ১০টি পরিবার মিলে একটি নলকূপের পানি পান করতে হচ্ছে।
এছাড়া ঘর বরাদ্দে সুবিধাভোগীদের কাছে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে ইউএনওর বিশেষ টোকেন ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ইউএনও।