Friday, July 18, 2025
Homeজাতীয়ফোন ট্র্যাকিং ও গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে 'কথা বলাই যাচ্ছে না'

ফোন ট্র্যাকিং ও গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে ‘কথা বলাই যাচ্ছে না’

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

মোজো ডেস্কঃ
জুলাই হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নিয়ে একজন উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক ফজলে রাব্বী, যেটা নিয়ে পরে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি হয়। ফেসবুকের হুমকি, বিতর্ক শেষ পর্যন্ত গড়ায় তার চাকরি হারানো পর্যন্ত।

প্রায় তিন মাস ধরে বেকার জীবন কাটছে ফজলে রাব্বীর।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “তখন সরকারি গেজেটে শহীদের সংখ্যা বলা হচ্ছিলো সাড়ে আটশত বা এরকম একটা সংখ্যা। কিন্তু উপদেষ্টা বলছিলেন চৌদ্দশত মানুষ হত্যা হওয়ার কথা। এটা কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব। যেখানে পাঁচই অগাস্টের পরে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের সংখ্যাটাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।”

“আমি এটাই বলছিলোম যে, তার কথাটা পলিটিক্যাল রেটোরিকের মতো শোনাচ্ছে। শহীদের সংখ্যা চৌদ্দশত? নাকি গেজেটে যেটা আছে সেটা, অর্থাৎ সাড়ে আটশত? আমি এটাই প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশ্নটা শেষ করতে পারিনি।”

ফজলে রাব্বী এবং অন্যদের প্রশ্নের ভিডিওটি পরে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মি. রাব্বী দেখতে পান, তাকে নিয়ে নানা হুমকি দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে হুমকি দেওয়া হয় তার প্রতিষ্ঠানকেও।

“থ্রেটটা পরে সেই তিনজন সাংবাদিকের প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে দেওয়া শুরু হলো। বলা হলো, এদের চাকরি থেকে না সরালে অফিস ঘেরাও করা হবে। পরদিন আমি বাধ্য হলাম চাকরি ছাড়তে। কারণ মালিকের তো শতকোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট। সে তো ভয় পেয়েছে,” বলেন তিনি।

ফজলে রাব্বী বলছেন, তিনি এখন নতুন করে চাকরিও পাচ্ছেন না।

“একটা ট্যাগ তো দিয়ে দিয়েছে আমাকে। এখন বড় ভাইদের কাছে যখন চাকরির জন্য যাই, তারা অপেক্ষা করতে বলে। আসলে আমাকে নিয়ে তারা নিজেরা নতুন বিপদে পড়বে কি-না সে ভয় তো থাকেই। তিন মাস হয়ে গেলো প্রায়। এখনো তাদের ভয় আছে,” বলেন ফজলে রাব্বী।

বাংলাদেশে ফজলে রাব্বীর যে অভিজ্ঞতা গত কয়েকমাসে, এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না–– এমন আশা করা হলেও বাস্তবে গত একবছরে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বলেই জানাচ্ছেন অনেকে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার সংস্কার কিংবা ফোন ট্র্যাকিংয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে এখনো কথা বলা যাচ্ছে না।

“ফোন ট্রাকিংয়ের জন্য বা নজরদারির জন্য যেসব যন্ত্রপাতি এর আগে আনা হয়েছে, সেগুলো তার জায়গাতেই রয়েছে। এগুলোর অপব্যবহার যে আবার হবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না, যদি না আমরা এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব সংস্কারের দিকে যাই।”

“কিন্তু এর কোনো সম্ভাবনাই আমরা দেখছি না এখনো। এগুলো নিয়ে কথা বলাই যাচ্ছে না,” তিনি বলেন।

‘বাঁচার জন্য কাকে ফোন দেবো?’
ঢাকার একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু। কয়েকমাস আগে তিনি হুমকিতে পড়েন একটি রিপোর্ট লেখার সূত্র ধরে।

এরপর তার ব্যক্তিগত ইউটিউব এবং ফেসবুক কন্টেন্ট নিয়েও হুমকি আসতে থাকে। যেখানে তিনি সমসাময়িক রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণ করতেন।

“একটা অপপ্রচার করা হয় যে, কন্টেন্টে আমি আগের সরকারের পক্ষে কথা বলছি। এখন একটা বিষয় হচ্ছে, আপনি যখন সত্য বলবেন, সেটা কারো না কারো পক্ষে যায়। এক শ্রেণির লোক আসলে সেটাকেই পুঁজি করে কথা বন্ধ করানোর জন্য সেগুলো ব্যবহার করেছে,” বলেন নুরুজ্জামান লাবু।

তিনি জানাচ্ছেন, হুমকির মুখে এখন ফেসবুক-ইউটিউবে কন্টেন্ট বানানোও বন্ধ করে দিয়েছেন।

“কন্টেন্ট থেকে কিছু টাকা পেতাম। সেটা বন্ধ হলো। সবচেয়ে বড় বিষয় আমার কথা বন্ধ হলো। এই কথা বন্ধ করার জন্য আগের সরকারগুলো সরাসরি ভূমিকা পালন করেছে। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আইন-আদালত দিয়ে গ্রেপ্তার করেছে।”

“সেরকমটা আমার ক্ষেত্রে হয় নাই। সরকারের কেউ আমাকে নিষেধ করেনি। কিন্তু নানা ধরনের ‘নন স্টেট অ্যাক্টরের’ যে হুমকি, মবের যে ভয়, সেটার কারণে অনেকে নিজে নিজে কথা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমিও বাধ্য হয়েছি,” বলেন মি. জামান।

তার প্রশ্ন মব হলে কার কাছে যাবেন?

“কোনো একটা মব আসলে আমি কাকে ফোন করে বলবো? কে আসবে বাঁচাতে? আমি তো অসহায়।’

‘আগে ছিল কৃত্রিম স্বাধীনতা, এখন সব একতরফা’
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে ঝুঁকি, সেটা নতুন নয়। দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির মতোই গণমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও বছরের পর বছর উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।

তবে পাঁচই অগাস্টের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে এমন আশা করা হলেও বাস্তবে সেটা হয়নি বলেই মত পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিতি আছে এমন সব সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে হত্যা মামলায় গ্রেফতার এবং সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের মতো ঘটনায় দেশে-বিদেশে সমালোচনা হয়েছে।

এছাড়া মব সৃষ্টি করে গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ, নিউজ সরাতে চাপ দেওয়া কিংবা চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করার মতো ঘটনাও আছে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ঢালাও মামলা দেওয়া সমাধান নয়।

তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, আমার যদি কোনো দুর্নীতি থাকে তাহলে আপনি সেটার মামলা করেন। কিন্তু আপনি মিথ্যা মামলায় জড়াবেন কেন? এটা কিন্তু গণমাধ্যমের জন্য একটা থ্রেট হয়ে গেলো।”

তার মতে, ভবিষ্যতে ভিন্নমতের সাংবাদিকদের একইভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার সুয়োগ থাকবে।

“সবাই জানে আমি শেখ হাসিনার সমালোচক। এখন কোনো কারণে যদি পাঁচ বছর বা দশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন তো সেই ভিক্টিম বা এখনকার এদের পরিণতি আমারও হতে পারে। ফলে এটা তো আমার জন্যও স্বস্তিকর হলো না। অন্য অনেকের জন্যও স্বস্তিকর হলো না,” বলেন মোস্তফা ফিরোজ।

এছাড়া গণমাধ্যমের অবস্থা আগের মতোই আছে বলে মনে করেন তিনি।

“গণমাধ্যমে আগে একধরনের কৃত্রিম স্বাধীনতা ছিল। নানা ধরনের মত আসতে পারতো, প্রকাশ হতো। কিন্তু ক্রুশিয়াল সময়ে আবার সবাই সরকারের পক্ষে একটা অবস্থান নিতো। কিন্তু সাজানো থাকতো যে সব দল আছে, সব মত আছে।”

“কিন্তু এখন যে চেহারা সেটা হচ্ছে–– আগে ছিল কৃত্রিম স্বাধীনতা, এখন সব একতরফা- একচেটিয়া,” বলেন মোস্তফা ফিরোজ।

অবস্থার পরিবর্তন কেন হলো না?
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনামলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় গুম-খুন কিংবা ভিন্নমতের পত্রিকা-টিভি বন্ধের মতো ঘটনায়।

কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন কেন হলো না? এখানে সরকারের ভূমিকাই বা কতটা দৃশ্যমান?

এমন প্রশ্নে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারের দিক থেকেও পদক্ষেপের অভাব আছে।

“কোনো কোনো মিডিয়া যারা বস্তুনিষ্ট খবর প্রকাশের জন্য সুখ্যাতিসম্পন্ন, তাদেরকেও টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকার যে খুব ভালো বা ইতিবাচক কোনো অবস্থান নিয়েছে, সেটা বলার সুযোগ নাই।”

“এছাড়া জাতিসংঘের রিপোর্টে যেসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে যে, এসব প্রতিষ্ঠান মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ায় কাজ করেছে, অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, তাদের সংস্কারের কথা কিন্তু বলা হয়েছিলো। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। তাদের বিষয়ে কোনো কথা বললে সেটাও প্রকাশিত হয় না।”

এছাড়া ফোনে আড়িপাতার সমাপ্তি কীভাবে টানা হবে সেটাও স্পষ্ট নয় বলে জানান ইফতেখারুজ্জামান।

“ফোন ট্রাকিং এর জন্য বা নজরদারির জন্য যেসব যন্ত্রপাতি এর আগে আনা হয়েছে, সেগুলো তার জায়গাতেই রয়েছে। এগুলোর অপব্যবহার যে আবার হবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। যদি না আমরা এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব সংস্কারের দিকে না যাই। কিন্তু এর কোনো সম্ভাবনাই আমরা দেখছি না এখনো। এগুলো নিয়ে কথা বলাই যাচ্ছে না।”

দেখা যাচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকার কী করছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানতে তথ্য উপদেষ্টার মন্তব্য চাওয়া হলেও পাওয়া যায়নি।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, গণমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে সেটারই তো কোনো আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।

তিনি বলেন, “গণমাধ্যম যদি স্বাধীন হয়, তাহলে টেলিভিশনগুলো সংকুচিত কেন? সে কেন মবের ভয় করছে? সে কেন মনে করছে যে আমি বিপক্ষ কাউকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানালে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। বরং এখনো গণমাধ্যমকে হুমকিই দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা বলেই যাচ্ছি যে গণমাধ্যম খারাপ। কিন্তু আমি তো মিডিয়াকে স্বাধীন করছি না।”

“যে কাঠামোর কারণে আমরা বলতাম যে মিডিয়া স্বাধীন না সেই কাঠামোই তো রয়ে গেছে। আপনি যে কোনো সময় যে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারেন। সে ধারা তো এখনো আছে। বাতিল করেননি। আপনি তো ন্যূনতম একটা অধ্যাদেশও জারি করতে পারতেন। তারপর সংস্কারের জন্য সময় নিতেন। কিছুই তো হয়নি!” বলেন মোস্তফা ফিরোজ।

সূত্রঃ বিবিসি নিউজ বাংলা

Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর