স্টাফ রিপোর্টারঃ
সমতলের চা শিল্প ডিজিটালের ছোঁয়া ও সঠিক তদারকিতে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে উৎপাদনের নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে পঞ্চগড় তথা সমতলের চা শিল্প।
বিগত বছরগুলোয় নানা অনিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কৃষকের ন্যায্য মূল্য, চোরা কারবারি, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব, নিলামের মূল্য পতন। ২০২৪ সালের শেষের দিকে চা বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান হয়ে আসেন মেজর জেনারেল শেখ সরওয়ার হোসেন, ইউএসপি,এনডিসি, পিএসসি। তিনি যোগদান করার পর সকল চা চাষি, চা ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কাস্টমস সহ অন্য অন্য সংস্থার সাথে মত বিনিময় ও চোরাচালান রোধ বিষয়ক সভা করেন।
এরপর তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ড এর পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিস ঢেলে সাজিয়ে তোলেন। অফিসার্স ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রজেক্টের ডেভলপমেন্ট ইউনিট (পিডিইউ) এর কর্মকর্তা আরিফ খান। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান এর বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতায় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পঞ্চগড়ের চা শিল্প। বিগত বছরগুলোয় দেখা গেছে কৃষকদের আর্তনাদ, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আন্দোলন। জেলা প্রশাসন থেকে কৃষকদের প্রতিকেজি কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ ছিল ১৭ টাকা। কিন্তু চা কারখানাগুলো সে অর্থ না দিয়ে কর্তন করে কেজিতে মূল্য পরিশোধ করতো ৮ থেকে ৯ ও সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। তেতুলিয়া উপজেলার তিরনাই হাট এলাকার কৃষক জাহাঙ্গির আলম বলেন_ আমরা বর্তমানে ভাল পাতা দেওয়ার অভ্যাস করছি। গত মৌসুমের এই সময়ে আমি সর্বোচ্চ মূল্য পেয়েছিলাম ১৫ টাকা এছাড়া কর্তন হয়েছিল ৩৫% পর্যন্ত। আর একই সময়ে এই মৌসুমে আমি চা পাতার সর্বোচ্চ মূল্য পেয়েছি ২২.৫০ পয়সা করে, ও কর্তন ছিল ১৫% পর্যন্ত। তবে তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, ফ্যাক্টরিতে চা দালাল ছাড়া দেওয়া যায় না। যদি সরাসরি আমাদের থেকে চা ক্রয় করার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমরা আরও মূল্য পাবো, এছাড়া বর্তমান সার ও কিটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের উৎপাদনে হিমশিম খাওয়া হচ্ছে।
আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল আলম বলেন_ আমরা বর্তমানে ভাল মূল্য পাচ্ছি, আগের তুলনায় কর্তনের পরিমাণ কম। এখন প্রায় সব চাষি মেশিন দিয়ে চা উঠায়। এতে করে সবার সুবিধা হয়ে থাকে। আশাকরি সামনে আমাদের ভাল সময় আসবে। তিনিও একই সুরে বলেন, উৎপাদনের খরচ তুলতে একটু কষ্ট হলেও সামনের দিনের অপেক্ষায় আছি।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার ইসলামবাগ গ্রামের কৃষক মোঃ আলাউদ্দীন বলেন_গত বছর এই সময়ে আমি চায়ের দাম পেয়েছিলাম ১৪ টাকা করে, বর্তমান এই সময়ে মূল্য পাচ্ছি ১৭ টাকা করে ও সর্বোচ্চ পেয়েছি ২০ টাকা করে। তবে তিনি বলেন যদি সরাসরি আমাদের থেকে চাপাতা ফ্যাক্টরি ক্রয় করত, তাহলে আমরা ন্যায্য মূল্য পেতাম। দালালদের থেকে সিরিয়াল নিতে হয় ও মাঠ পর্যায়ে তাদের কাছে পাতা বিক্রয় করতে হয়। যদি চা বোর্ড এ প্রশাসন এ বিষয়গুলো দেখত তাহলে আমাদের জন্য ভাল হত।
বাংলাদেশ চা বোর্ড এর তথ্য অনুযায়ী গত বছরের গ্রীন লিফের তথ্য না থাকলেও মে মাসে টি সফট এর মাধ্যমে কৃষকদের ডাটাবেইজ তৈরি করে গ্রীনলিফের তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে চা বোর্ড। মে মাসে সমতল থেকে গ্রীণলিফ আহরণ হয়েছে ১ কোটি ১১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৫ শত ৬৪ দশমিক ৯৯ কেজি। এছাড়া গত বছর একই সময়ের মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে সমতলে চা পাতা থেকে মেট (তৈরি) চা উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লক্ষ ৫৭ হাজার ৭ শত ৬৬ কেজি। আর ২০২৫ এর মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে মোট উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লক্ষ ১৬ হাজার ০২ কেজি। এছাড়া মৌসুমের শুরুতে অতীব খড়া, অনাবৃষ্টি ও চা গাছ উঠিয়ে ফেলা সত্ত্বেও এবছর একই সময়ে চা পাতার উৎপাদনের পরিমান ১১১.৫৬% বেড়েছে যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড এ স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া শুধু রেকর্ডেই হয়নি, গুণগত মানের চা তৈরি করতে পেরেছে সমতলের চা কারখানাগুলো। ” আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চায়ের গুণগতমান ঠিক করা, চা কারখানাগুলোকে সঠিক নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা ও কোথায় কোথায় ভুলগুলো করেছে সেগুলো চিহ্নিত করে সঠিক সমাধান ও সঠিক নিয়মে নিয়ে আসা, ইতিমধ্যে আপনারা দেখেছেন এখন নিলাম মার্কেট এ চা পাতার মূল্য অনেক পাচ্ছে, তার মূল কারণগুলো হলো চায়ের কোয়ালিটি আর স্বচ্ছতা। আশাকরি সামনে আরও ভালো কিছু দেখতে পাবেন। ” – আরিফ খান, বাংলাদেশ চা বোর্ড – পঞ্চগড়।
দেখা গিয়েছে গতবছরের তুলনায় নিলাম মার্কেট এ চা কারখানাগুলোর চায়ের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। মূল্য পাওয়ার থেকে বড় যে বিষয়টি তা হল সঠিক নিয়মে চায়ের বিপণন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। গত বছর চায়ের মূল্য না পেয়ে হতাশায় ছিল চা কারখানাগুলো, অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূত করে চা বিপণন করে আসছিল কিছু চা কারখানা। যার কারণে নিলাম মার্কেট এ হতাশায় ছিল বায়ার ও চা ব্রোকার্স রা। কিন্তু বর্তমানে সঠিক নিয়ম ও কাস্টমস ও চা বোর্ডের তদারকিতে নিয়মের মধ্যে আসতে বাধ্য হচ্ছে চা কারখানাগুলো। এছাড়া বাংলাদেশ চা বোর্ড এর চা বিপণন, ইনভেন্টরী ও ওয়্যারহাউজিং ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম সফটওয়্যার “টি সফট” এর মাধ্যমে সঠিক নিয়মে চা ডেসপ্যাচ হচ্ছে, একই সাথে চায়ের সঠিক পরিসংখ্যানের ডেটাবেইজ ও কৃষকের ডেটাবেইজ তৈরি হচ্ছে। বিগত বছরে একই সময়ে দেখা গেছে চায়ের নিলাম মার্কেট এ পঞ্চগড়ের চা বিক্রি হয়েছিল ১৬০ টাকা ও খোলা বাজারে নিয়মবহির্ভূত চা বিক্রি হয়েছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। আর একই সময়ে এ বছরে নিলাম বাজারে বিক্রি মূল্য ১৬৮ টাকা ও কিছু নিয়মবহির্ভূত চা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়। বর্তমানে কিছু অসাধু চা কারখানা ও চা ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত চা ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি করে আসছে, যা সঠিক নিয়মে বিক্রি হলে ভ্যাট, ট্যাক্স, সেস ও ব্রোকার্স ওয়্যারহাউজ চার্য সহ মূল্য দাঁড়াতো ২০০ টাকা ৬০ পয়সায়। যেখানে নিয়মবহির্ভূতের কারণে সরকার হারায় কেজিতে গড়মূল্যে ২৯ টাকা ৪৫ পয়সা করে।
অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে বড় ব্যবধানে নতুন রেকর্ড ও বিগত সময়ে এই পরিসংখ্যান উঠে আসেনি কেন এ সম্পর্কে বাংলাদেশ চা বোর্ডের যুগ্মসচিব ( গবেষণা ও উন্নয়ন) সদস্য ড. পীযূষ দত্ত বলেন___ আমরা পঞ্চগড়কে গুছিয়ে নিয়েছি, চেয়ারম্যান মহোদয় সহ সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা সময় সবাই চা মানে সিলেট বুঝলেও পঞ্চগড়ে যে অনেক চা আবাদ হয় তা সবাই বুঝতে। এছাড়া পঞ্চগড়ের চায়ের কোয়ালিটি নিয়েও অতীতে অনেক বদনাম হতো, তা আর এখন নেই। নিলাম মার্কেট এ তাদের চা ভাল দাম পাচ্ছে। আর বিগত সময়ে কেন এমন হয়েছে তার উত্তরে তিনি বলেন, হয়ত পরিসংখ্যান এর অভাব বা অস্বচ্ছতা। চা চোরাচালান সম্বন্ধে তিনি বলেন সবাই মিলে আরও ভাল করে কাজ করে এ সকল রোধ করা সম্ভব। এছাড়া লালমনিরহাট জেলার চা চাষিদের জন্য সেলস ও বায়িং সেন্টার খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড এর পক্ষ থেকে। যেখানে লালমনিরহাটের কৃষকরা সহজেই চা পাতা বিক্রি করতে পারে ও সঠিক মূল্য পেয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ পঞ্চগড়ে অবৈধ চায়ে মাসে আড়াই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে কুরিয়ারের মাধ্যমে।
আরও পড়ুনঃ পঞ্চগড়ে চা চোরাচালান রোধ এবং উন্নয়ন বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত।
উল্লেখ যে, কত কয়েক বছর থেকে নানা অনিয়ম, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব, স্বচ্ছ জবাবদিহিতা, নীতিমালা প্রয়োগের অনিহার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল সমতলের চা শিল্প। কৃষকের জন্য পঞ্চগড়ে চা শিল্পের দিকে সরকার কাজ করলেও মূলত সব সময় কৃষকরা থাকত অবহেলিত। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান আসার পর তিনি কথা দিয়েছিলেন শতভাগ নিয়মে না আসলেও একটি দৃশ্যমান কাঠামো এ বছরেই দেখতে পাবেন। তার ফল এখন আমরা পাচ্ছি – এমনটাই বলেছিলেন চা চাষি।
এদিকে সমতল তথা করতোয়া ভ্যালির চা শিল্প আরও উন্নত হবে ও চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সবাই লাভবান হবেন। অপরদিকে অর্থনীতিক ও সামাজিক সচ্ছলতা এগিয়ে যাবে কৃষক শ্রেণীর লোকেরা এমনটাই আশা সংশ্লিষ্ট সবাই।