Sunday, July 13, 2025
Homeজাতীয়হরিপুর-চিলমারী সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষা নতুন স্বপ্নে বিভোর দুই জেলার মানুষ

হরিপুর-চিলমারী সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষা নতুন স্বপ্নে বিভোর দুই জেলার মানুষ

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
আনোয়ার হোসেন, গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আলোর দিশারি হয়ে আসছে হরিপুর-চিলমারী দ্বিতীয় তিস্তা সেতু। গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। চলতি মাসের শেষ দিকে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে, যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে।
গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ঘাট এলাকায় নির্মিত এই সেতুটি জেলা শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর অপর প্রান্তে কুড়িগ্রামের চিলমারী ঘাট। এই দুই জেলায় সংযোগ স্থাপনকারী সেতুটি শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নয়ন ঘটাবে না বরং এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও জনজীবনে আনবে এক অভাবনীয় পরিবর্তন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর-এলজিইডি গাইবান্ধা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর এই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ‘চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড’ এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। সেতুটিতে পিলার রয়েছে ৩০টি। এর মধ্যে ২৮টি পিলার রয়েছে নদীর ভেতরের অংশে এবং দুটি পিলার রয়েছে বাইরের অংশে। সেতুর উভয় পাশে নদী শাসন করা হয়েছে ৩.১৫ কিলোমিটার করে। সেতুর উভয় পাশে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে ৫৭.৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে চিলমারী মাটিকাটা মোড় থেকে সেতু পর্যন্ত ৭.৩ কিলোমিটার এবং গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর ধাপেরহাট থেকে হরিপুর সেতু পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার। চিলমারী অংশে একসেস সড়ক সেতু থেকে কাশিমবাজার পর্যন্ত ৫.৩ কিলোমিটার এবং গাইবান্ধা ধাপেরহাট থেকে হরিপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, এলজিইডিয় প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশীদ মিয়া ও যুগ্ম সচিব মো. সামছুল ইসলাম তিস্তা সেতু পরিদর্শনে আসেন। তারা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান যে, সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে এবং ঠিকাদারি
প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত তা শেষ করতে বলা হয়েছে। কাজ সম্পন্ন হলেই সেতুটি চালু করা হবে।
এই সেতু ও সংযোগ সড়ক চালু হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার কমে আসবে, যা সময় সাশ্রয় করবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। শুধু গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম নয়, উত্তরাঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে। গাইবান্ধার মতো তুলনামূলক পশ্চাৎপদ একটি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও এই সেতু বড় ভূমিকা রাখবে।
গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল চৌধুরী বলেন, দেশে এলজিইডির সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই তিস্তা সেতু। সেতুটি উন্মুক্ত হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১৩৫ কিলোমিটার। এতে সময় সাশ্রয় হবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। মূল সেতুর কাজ শেষ। কিছু সংযোগ সড়ক ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ বাকি। চলতি মাসেই সেতু চালুর চেষ্টা করছি। সেতু চালুর পর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান বাড়বে।
তিস্তা সেতু শুধু একটি কংক্রিটের কাঠামো নয়, এটি গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের লাখো মানুষের স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনার প্রতীক। এই সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে অবহেলিত এই জনপদের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে, খুলে যাবে নতুন নতুন অর্থনৈতিক দুয়ার। এই সেতু অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে, এমনটাই আশা করছেন স্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা।
তিস্তা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য নব্বইয়ের দশক থেকে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবেদন করে আসছিল তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক শরিয়ত উল্যা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চিলমারী-হরিপুর তথা কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার মানুষের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের অভাবে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হতো। নদীপথে নৌকায় যাতায়াত ছিল সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে কৃ যিপণ্য পরিবহন এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সমস্যা প্রকট ছিল। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। সরকার উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করে এই সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে
নেয়। এই সেতু শুধু দুই জেলার মানুষের মধ্যে দূরত্ব কমাবে না, বরং রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও সুগম করবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করা যাবে।
গাইবান্ধা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. মকছুদার রহমান শাহান বলেন, তিস্তা নদীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হরিপুর-চিলমারী দ্বিতীয় তিস্তা সেতু। এটি শুধু একটি সেতু নয়, এটি উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দিগন্ত। বিশেষ করে গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম দুই জেলার মানুষের স্বপ্নপূরণের সেতুবন্ধ। এই সেতু উত্তরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। সেতুর কারণে পণ্য পরিবহন সহজ হওয়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। ব্যবসায়ীরাও সহজে পণ্য আদান-প্রদান করতে পারবেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
হরিপুর-চিলমারী দ্বিতীয় তিস্তা সেতুকে অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দিগন্ত উল্লেখ করে নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ গাইবান্ধার সদস্য সচিব বলেন, এখন রংপুর হয়ে অনেক দীর্ঘ পথ ঘুরে গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম দুই জেলার মধ্যে যোগাযোগ করতে হয়। সেতুর কারণে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাওয়া সম্ভব হবে, যা সময় ও অর্থের সাশ্রয় করবে। এ ছাড়া তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এই সেতুকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে। স্থানীয়ভাবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ছোট ব্যবসা যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হস্তশিল্পের দোকান ইত্যাদির বিকাশ হবে, তেমনি সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা প্রাপ্তিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
সেতু নির্মাণের পর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও এর পূর্ণ সুফল পেতে হলে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেতুর উভয় পাশে মানসম্মত সংযোগ সড়কের উন্নয়ন, স্থানীয় অবকাঠামোর আরও উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের উদ্যোগ নেওয়া গেলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে।
Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর