Sunday, July 13, 2025
Homeপঞ্চগড়পরিবারের ছায়াহীন শৈশব থেকে এসএসসির সাফল্যে: পঞ্চগড়ের ১২ পথশিশুর জীবনে নতুন ভোর

পরিবারের ছায়াহীন শৈশব থেকে এসএসসির সাফল্যে: পঞ্চগড়ের ১২ পথশিশুর জীবনে নতুন ভোর

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

ইকবাল বাহার, পঞ্চগড়

রেলস্টেশনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া, কিংবা পারিবারিক অবহেলায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া ছোট্ট কোনো প্রাণ—এদের কারো মুখে হাসি ছিল না, চোখে ছিল না আগামী স্বপ্নের রেখা। ছিল না কোনো আপনজন, কিংবা একটুকরো মমতা। বয়স বাড়লেও তাদের হৃদয়ের কোনো কোণে জায়গা করে নেয়নি নিরাপত্তা বা আশ্রয়ের অনুভূতি। তবে এইসব শিশুরাই আজ গর্বিতভাবে বলছে—”আমরাও পারি।”

এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে এমন ১২ জন কিশোর, যারা পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী’-তে বেড়ে উঠেছে পরিবারহীন জীবন নিয়ে। হারিয়ে যাওয়া, পরিত্যক্ত, কিংবা অনাথ হয়ে ওঠা এসব কিশোর এখন শিক্ষা, স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাসের পথে এগিয়ে চলেছে দৃঢ় পায়ে। পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে তারা এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।

উত্তীর্ণ হওয়া এই ১২ জন কিশোরের নাম—কবির হোসেন হৃদয়, সাব্বির হোসেন, সফিকুল ইসলাম, পারভেজ রানা, আব্দুল মজিদ, সুজন আলী, রাকিবুল হাসান, বরজুল রহমান বায়েজিদ, তাপস চন্দ্র রায়, জিহাদ মিয়া, আল আমিন ও হৃদয় কুমার।

শিশুকালেই হারিয়ে ফেলা শিকড়: কেউ পারিবারিক দ্বন্দ্বের শিকার, কেউবা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া নামহীন মুখ। কারো কোনো স্মৃতিই নেই জন্মভূমি বা আপনজনের। কবির হোসেন হৃদয়ের মতো কেউ কেউ শুধু স্মৃতির আবছা রেখায় ধরে রেখেছে বাবার নাম কিংবা বাড়ির জেলা।

কবির হোসেন হৃদয় (জিপিএ-৪.৯৬) “ছোটবেলাতেই বাবা-মার বিচ্ছেদ আমাকে অন্ধকার জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসি। পথশিশু হয়ে রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়াতাম। ২০১৪ সালে এক সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই শিশু নগরীতে আশ্রয় পাই। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ—এইটুকুই মনে আছে। আজ এসএসসিতে জিপিএ ৪.৯৬ পেয়ে মনে হচ্ছে, আমি আবার নতুন করে বাঁচছি। বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে চাই, তাদের দেখাতে চাই আমি হারিয়ে যাইনি।”

আব্দুল মজিদ (জিপিএ-৪.৮২)
“আমার বাড়ি লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডারে। পরিবার ছিল, ভালোবাসা ছিল। কিন্তু ছোটবেলায় হারিয়ে যাই। এখানেই নতুন করে জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে পরিবারের সন্ধান মিললেও আর ফিরে যাইনি। কারণ এখন এই শিশুনগরীই আমার বড় ঠিকানা। একসময় মনে হতো আমি কিছুই পারবো না, কিন্তু আজ এসএসসি পাশ করেছি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখন ইচ্ছে—ভালো করে পড়াশোনা করে একজন ভালো মানুষ হওয়া।”

সাব্বির হোসেন (জিপিএ-৪.৭৫)
“পরিবার থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর কোথা থেকে এসেছি, সেটা জানি না। শুধু মনে আছে বাবার নাম মারুফ, মায়ের নাম ছবি আক্তার। কখনো মা-বাবার আদর পাইনি। আত্মীয়-স্বজন আছে কি না, তাও জানি না। এই শিশুনগরীই আমাদের ঘর, এখানকার স্যাররাই আমাদের অভিভাবক। আমি আজ এসএসসি পাস করেছি, এটা যেন স্বপ্ন। খুব ভালো কিছু করে সবার কাছে প্রমাণ করতে চাই—আমরাও পারি।”

সফিকুল ইসলাম (জিপিএ-৪.৫০)
“আমার মা সুখি আক্তার, বাবার নাম আব্দুস সালাম—এইটুকু মনে আছে। কিন্তু কোথায় আমাদের বাড়ি, কেমন ছিল আমাদের পরিবার, কিছুই মনে নেই। মা-ছেলে দুজনই যেন সুখ থেকে বঞ্চিত। মা’কে সুখি নামের উপযুক্ত করতে চাই, যাতে একদিন গর্ব করে বলতে পারেন—‘এটাই আমার ছেলে’। এসএসসি পাস করেছি, এখন শুধু চাই মা-বাবার খোঁজ পেতে।”

পারভেজ রানা (জিপিএ-৪.২১)
“আমার বাবার নাম হারুন, মায়ের নাম পারুল—এইটুকুই মনে আছে। খুব ছোট বয়সে নিখোঁজ হয়ে যাই। পরে সমাজকর্মীদের মাধ্যমে এই আশ্রয়স্থলে আসি। আজ আমি এসএসসি পাস করেছি। কখনো ভাবিনি এত দূর আসতে পারবো। এখন স্বপ্ন দেখি—আরও এগিয়ে যাওয়ার, নিজের পরিচয় গড়ার।”

সুজন আলী (জিপিএ-৪.১৪)
“বাবা আব্দুল হামিদ আর মা আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে কোনো এক রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাই, আর কখনো তাদের খুঁজে পাইনি। শুধু মনে আছে আমাদের বাড়ি ভৈরব, কিশোরগঞ্জে। আজ এসএসসিতে পাস করলাম, কিন্তু মনে বড় শূন্যতা—বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরার মতো কাউকে খুঁজে পাই না। জানি না কোনো দিন তাদের ফিরে পাবো কি না।”

তাপস চন্দ্র রায় (জিপিএ-৩.৬৮)
“জন্মের পরপরই বাবা সুকুমার রায় নিরুদ্দেশ হন। বেঁচে আছেন কি না, জানি না। তবে মায়ের নাম শিঞ্জিবালা, বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে—এইটুকু জানি। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে বাবা নামক অভাবটা কখনো পূরণ হয়নি। আজ এসএসসি পাস করে মনে হচ্ছে—জীবনের একটা বড় লড়াই আমি জিতে গেছি।”

আলোর পথের দিশারী ‘আহছানিয়া’: ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী’ বর্তমানে প্রায় ১৬০ জন শিশুকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এখানে অনাথ, পথশিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বঞ্চিত শিশুরা নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠছে। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিনোদন—সবকিছুই মিলিয়ে গড়ে উঠছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের ভিত্তি।

শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম জানান, “আমরা শিশুদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়াই। এরপর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিই। এই ১২ জনও আমাদের এখান থেকেই শুরু করেছিল। ওদের সফলতা আমাদের জন্য গর্বের।”

কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, “শুরুর দিকে শিশুরা অনিরাপত্তায় ভোগে। কিন্তু পরে তারা বুঝতে শেখে—এটাই তাদের আশ্রয়। এখানেই তারা বড় হয়ে উঠছে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। এখন পর্যন্ত এ শিশু নগরী থেকে ২৪ জন এসএসসি পাস করেছে। তাদের জন্য গড়ছে কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ।”

শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দিপক কুমার রায় বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো, যেসব শিশু অন্ধকারে পথ চলছিল, তাদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনা। এবার ১২ জন এসএসসি পাস করেছে—এটা শুধু সংখ্যার সাফল্য নয়, এটা আশা ও পুনর্জন্মের গল্প।”

তিনি আরো বলেন, “শিশু নগরীতে থাকা অন্যান্য ১৬০ জন শিশুও এখন এ ১২ জনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চায়। তাদের চোখে এখন নতুন স্বপ্ন—শিক্ষিত হওয়া, স্বনির্ভর হওয়া, এবং একদিন হয়তো পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার।”

স্বপ্নছোঁয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আদম সুফি বলেন, “যেখানে পরিবার ছিল না, সেখানে আশ্রয় হয়েছে প্রতিষ্ঠান। যেখানে ভালোবাসার অভাব ছিল, সেখানে শিক্ষকেরা হয়েছেন অভিভাবক। এই শিশুরা প্রমাণ করেছে—যত হারানোই হোক, যত দুঃখই থাকুক, যতটা শূন্যই থাকুক অতীত—আশ্রয়, শিক্ষা ও মমতা পেলে যেকোনো জীবনই নতুন করে গড়ে ওঠে। এ সাফল্য শুধুই পরীক্ষার ফলাফল নয়, এটি মানবতা, সহানুভূতি আর সামাজিক দায়িত্ববোধের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত।”

তিনি আরও বলেন, “আমি একাধিকবার গিয়েছিলাম আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে। গত রমজানেও ওদের সঙ্গে ইফতার করেছি। সেখানে শিশুদের চোখেমুখে যে আগ্রহ, স্বপ্ন আর সাহস দেখেছি, তা অনন্য। সমাজের বিত্তবান ও সচেতন মানুষদের প্রতি আমার অনুরোধ—এ ধরনের শিশুদের পাশে এগিয়ে আসুন। তাদের জন্য সহানুভূতি নয়, প্রয়োজন সমান সুযোগ। তারা কারো করুণা নয়, বরং একটি সহানুভূতিশীল সমাজে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। এই শিশুরা পারে, শুধু দরকার পথ দেখানোর হাতটি।”

Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর