মোঃ মাহফুজুর রহমান সরকার,ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ
আকাল চলছে দেশীয় মাছের ৬০০শ টাকা কেজিতেও মিলছে না এক কেজি দেশীয় ছোট মাছের।সেচ, কারেন্ট জাল ও রাসায়নিক ব্যবহার, ঘোড়াঘাটে নদী-নালা, খালবিলে দেশী মাছ শূন্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটেও নানা প্রজাতির দেশীয় ২শ ছোট মাছ বিলুপ্তির পথে।
নদী, নালা, খাল, বিল হাওড়, বাঁওড় সহ মুক্ত জলাশয় গুলো মাছ শূন্য হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে ছোট মাছের আকাল চলছে। এসব মাছের স্থলে স্থান পেয়েছে বিদেশি বিভিন্ন সংকর প্রজাতির মাছ।
নদ-নদীর নাব্যতার হ্রাস উজানে বাধ নির্মাণ নদীর সন্নিকটবর্তী খাল, বিল ও জলাশয়ের গভীরতা কমে যাওয়া, পুকুর, ডোবা-নালা ভরাট করে ফসলি জমি তৈরি মা মাছের আবাসস্থল, ডোবা নালা সেচে মাছ ধরা অপরিমিত রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার জলাশয় দূষণ, বিদেশি আগ্রাসী, রাক্ষুসে মাছের চাষ প্রাকৃতিক বিপর্যায় ইত্যাদি পরিবেশ পরিস্থিতিতে দেশীয় প্রাকৃতিক মাছ বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণে ছোট মাছের বিলুপ্তি ঘটছে।
ঘোড়াঘাট উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘোড়াঘাট উপজেলার মাছের মোট চাহিদা ২৮৭৮.০ মেঃ টন, মোট উৎপাদন ২১৭৩.৭৮ মেঃ টন, ২০২৫ সালে উৎপাদন হয়েছে ২৮০০.০ মেঃ টন।
এখানে কোন মৎস্য অভয়ারণ্য নাই। সরকারি দিঘী-পুকুর সংখ্যা ৮৯টি, এর আয়তন ৬৫.৫৯ হেক্টর, উৎপাদন হয়েছে ২৮০.১৮ মেঃ টন, বেসরকারি দিঘী-পুকুর রয়েছে ১৫৭টি, এর আয়তন ৩৩৭.৭৮ হেক্টর, উৎপাদন ১৪৪২.৯৩ মেঃ টন, বাণিজ্যিক মৎস্য খামারের সংখ্যা রয়েছে ৩৮টি, এর আয়তন ১৩.৩৮ হেক্টর, উৎপাদন ১৫৯.৪১ মেঃ টন, সরকারি বিলের সংখ্যা একটি আয়তন রয়েছে ৫.৮৭ হেক্টর, উৎপাদন ১৪.৫০ মেঃ টন, বেসরকারি প্লাবন ভূমির সংখ্যা ২২৫টি, এর আয়তন ১৭৮.৪৫ হেক্টর, উৎপাদন ৭৩.৫৫ মেঃ টন।
এখানে নদী রয়েছে ২টি। এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সর পুঁটি, তিতো পুঁটি, ডান কোনা,পবদা, লাল চান্দা, ময়া সহ ২শ প্রজাতির দেশীয় প্রাকৃতিক থেকে প্রাপ্ত দেশীয় ছোট মাছ।
এছাড়াও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে চলা পুঁটি, টেংরা, শিং, মাগুর, কৈ, শৈল, মহা শৈল, ফলই, গজার, বেলে, আইড়, বোয়াল, কাঁদা কাঠি, খলিশা,বাইম, চোপড়া, টাকি, ছোট চিংড়ী, মলা, ঢেঁলা,গতা, মুশা, মুর–লি, আকড়া, গোরকুতে, বাউশ, কাল বাউশ, সোবন খড়কি, বাতাসি, উড়া, খাকিলা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
গ্রাম অঞ্চলের হাট বাজারে এ সব প্রজাতির মাছ এখন আর খুব একটা চোখে পড়েনা। চেনা মাছ হয়ে গেছে খুবই অচেনা অপরিচিত।
বাজারগুলোতে প্রাকৃতিক দেশীয় ছোট মাছের আমদানি একে বারেই কমে গেছে। উপজেলা প্রধান প্রধান হাট বাজারগুলোতে যা কিছু আমদানি হয় তা চলে যায় ভাগ্যবান বা অর্থবিত্তদের থলেতে। সাধারণ মানুষদের কপালে এসব মাছ আর জুটছে না।
দেশীয় প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছের বংশ বিস্তার হার আশংকাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। মাছের ভরা মৌসুমে উপজেলার মৎস্য প্রধান এলাকা সহ হাট বাজারের দেশীয় ছোট মাছের সংকট বিরাজ করছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদী-নালা, খাল-বিল সহ মুক্ত জলাশয় গুলো প্রাকৃতিক দেশীয় মাছ শূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
পুষ্টির উৎস হিসেবে দেশীয় প্রজাতির মাছের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দেহ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন ছোট মাছ থেকে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে দেশের মানুষের শরীরে শতকরা ৮০ ভাগ আসে দেশীয় ছোট মাছ থেকে। মাছ সম্পর্কে বিজ্ঞানের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বাঙালির অতীত এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথা।
এক সময় মাছই ছিল বাঙালি জাতির এক মাত্র খাদ্য। এ খাদ্য সংস্কৃতিকে ঘিরেই রচিত হয় বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য “মাছে ভাতে বঙ্গালী”।
বাঙালি জাতি এই প্রবাদ বাক্য অনুসরণ করে এক সময় এ অঞ্চলে প্রচুর মাছ ছিল এবং মাছ প্রধান আমিষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
যার ফলে সে সময়ে বাঙালি জাতি ছিল নীরোগ ও কর্মঠ। কয়েক দশক আগেও দেশীয় প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছের কোনো ঘাটতি ছিল না।
নদী, নালা, হাওড়, বাঁওড়, খাল, বিল, ডোবা,নালা, খালা, খন্দ মুক্ত জলাশয় গুলিতে দেশীয় মাছের আধিক্য এত ছিল যে, মাছের জন্য পানিতে নামা জেত না।
গ্রামের মানুষ বেড়া জাল, সুতি জাল, ধর্ম জাল, পাতা জাল, ঠেলা জাল, চটকা জাল ও কাপড়ের জাল ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরত।
এক সময় মাছ খেতে খেতে বিমুখ হয়ে যেত গ্রামের মানুষ। মাছ খেয়ে কলেরা, ডায়রিয়া ও আমাশয় সহ নানা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হত। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত এসব মাছ শুকিয়ে শুক্টি করে সংরক্ষণ করত।
এ ছাড়াও মাংসাশী প্রাণীর মধ্যে মেছো বাঘ, শেয়াল, বেজি, বানর, উদ, কচ্ছপ, সাপ, গুই সাপ ইত্যাদি মাংসাশী প্রাণী নিয়মিত এ সব মাছ শিকার করে খেয়ে জীবন ধারণ করত। পাখিদের মধ্যে পান কৌড়, মাছ রাঙ্গা, গাংচিল, বক ইত্যাদি পাখি হাওড়, বাঁওড় থেকে মাছ শিকার করে জীবন ধারণ করত।জীববৈচিত্র্যের একটি বিরাট অংশ বেঁচে থাকত মাছ খেয়ে জীবিকা করে। এ সব এখন রূপকথার গল্পের মতো শুনায়।
বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এ চার মাস দেশীয় প্রজাতির প্রাকৃতিক ছোট মাছ না ধরা বা প্রাজাযোন ক্ষেত্র সংরক্ষণ, ডিম ওয়ালা মাছ প্রকৃতিতে অবমুক্ত করণ, ছোট মাছের প্রকৃতিতে অবমুক্ত করণ, ছোট মাছের সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে পরিবার এগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে এ সব মাছ শিকারের পরিবর্তে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, কীটনাশকের ব্যবহার কমানো ইত্যাদির মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ রক্ষা করা সম্ভব।