Tuesday, June 17, 2025
Homeদিনাজপুরঘোড়াঘাটে অবাধে চলছে ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ নিধন

ঘোড়াঘাটে অবাধে চলছে ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ নিধন

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

মোঃ মাহফুজুর রহমান সরকার, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ
ঘোড়াঘাট উপজেলার নদ-নদী ও খাল-বিল এখন বর্ষার পানিতে টইটম্বুর। বছরের বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ পর্যন্ত জলাশয়ে সবধরনের মাছ ডিম ছাড়ে। চারদিকে থৈ-থৈ পানি। বর্ষার পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত এ উপজেলায় দেশীয় প্রজাতির ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ নিধনের মহোৎসব শুরু হয়েছে।
নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, বাদাই জাল, খৈলশুনি ও শয়তান জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ দিয়ে অবাধে চলছে মা ও পোনা মাছ নিধন।হাটে-বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে অবৈধভাবে ধরা এ সব দেশীয় প্রজাতির মা মাছ ও পোনা মাছ। আর প্রতিবছরের মতো এবারও নিশ্চুপ মৎস্য বিভাগ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, মশারি দিয়ে তৈরি নেট জাল, বেড় জাল, বাদাই জাল, খৈলশুনিসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ দিয়ে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অসাধু মৎস্য শিকারিরা। বিশেষ করে শৈল ও টাকি মাছের পোনা মারতে মাতোয়ারা হয়ে উঠছেন তারা। আর করোনাকালীন অলস সময় পার করতে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের মাছ শিকারের প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে।
, ঘোড়াঘাট উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘোড়াঘাট উপজেলার মাছের মোট চাহিদা ২০৬৮.৫ মেঃ টন, মোট উৎপাদন ২১৭৩.৭৮ মেঃ টান, ২০২৪ সালে উৎপাদন হয়েছে ২২০০.০ মেঃ টন। এখানে কোন মৎস অভয়ারণ্য নাই। সরকারি দিঘী-পুকুর সংখ্যা ৮৯টি, এর আয়তন ৬৫.৫৯ হেক্টর, উৎপাদন হয়েছে ২৮০.১৮ মেঃ টন, উদ্বৃত্ত ৫ হাজার ৫০ মেট্রিকটন। বেসরকারি দিঘী-পুকুর রয়েছে ১৫৭টি, এর আয়তন ৩৩৭.৭৮ হেক্টর, উৎপাদন ১৪৪২.৯৩ মেঃ টন, বাণিজ্যিক মৎস খামারের সংখ্যা রয়েছে ৩৮টি, এর আয়তন ১৩.৩৮ হেক্টর, উৎপাদন ১৫৯.৪১ মেঃ টন, সরকারি বিলের সংখ্যা একটি আয়তন রয়েছে ৫.৮৭ হেক্টর, উৎপাদন ১৪.৫০ মেঃ টন, বেসরকারি প্লাবন ভূমির সংখ্যা ২২৫টি, এর আয়তন ১৭৮.৪৫ হেক্টর, এখানে নদী রয়েছে ২টি।

জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি টেংরা ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা, পুঁটি ৫শ’ টাকা, মোয়া মাছ ৫-৬শ’ টাকা, ডিমওয়ালা শৈল বা টাকি মাছের পোনাও ৪ থেকে ৫শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

ঠিক এ সময়ে নদ নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে ডিমওয়ালা মাছ নিধন করছে একশ্রেণীর লোকেরা। মাছ ডিম ছাড়ার পূর্বেই মেরে ফেলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বড় হবার পূর্বেই নিধন করা হচ্ছে নানা প্রজাতির পোনা মাছ। শিকারীদের হাত থেকে মাছ রেহাই পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মাছ জলাশয়ে থাকলে কয়েকগুণ উৎপাদন হত। এ অবস্থায় দেশীয় নানা প্রজাতির ডিমওয়ালা ও পোনা মাছের অভাব দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, উপজেলার সবস্থানেই কমবেশী নদী, ডোবা, নালা, খাল, বিল, পুকুরসহ নানা জলাশয় রয়েছে। এগুলো সরকারি ও বেসরকারি জমিতে অবস্থিত। এ অঞ্চলে রয়েছে সরকারী বিল ও নদী। শিকারীরা নানা কৌশলে কারেন্ট জালসহ অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে মাছ ধরে বিক্রি করছেন। বর্ষা এলে জলাশয়গুলোতে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে দেশীয় মাছ পূর্বের তুলনায় পাওয়া যাচ্ছে না।
এখনকার দিনে বর্ষার শুরু থেকে জলাশয়গুলোতে মাছ ধরতে কারেন্ট জাল, খুচা, ফারণ, বর্শি, অন্যান্য জালসহ নানা ধরণের যন্ত্র নিয়ে জলাশয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন শিকারীরা। এ কারণে মাছ ডিম ছেড়ে বংশ বিস্তার করতে বাধার মুখে পড়েছে। আর তাতে করে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে একশ্রেণীর লোকেরা প্রতিযোগীতামূলক কারেন্ট জাল ও অন্যান্য জাল দিয়ে ডিমওয়ালাসহ পোনা মাছ অবাধে শিকার করছে। তেমন কেউ এর প্রতিবাদ করছে না। অনেকে মন্তব্য করেছেন,এ অঞ্চলের মাছের নিরব কান্না শুনার কেউ নেই।

জলাশয়ে বাইম, টেংরা, রুই, কাতল, ঘনিয়া, আইড়, গজার, শৈল, বোয়াল, চাপিলাসহ ২৫ থেকে ৩০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এসব মাছ প্রাকৃতিকভাবে জলাশয়ে জন্ম নিয়ে থাকে। বাংলা বছরের বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত নানা প্রজাতির মাছগুলো জলাশয়ে ডিম ছাড়ে। এ সময় মাছগুলো শিকার না হলে ব্যাপক আকারে মাছের বিস্তার হত। কিন্তু একশ্রেণীর লোকজন কারেন্ট জালসহ নানা যন্ত্র দিয়ে মাছগুলো শিকার করছে। যদিও মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে এসব লোকদের হাত থেকে মাছগুলোকে রক্ষা করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে কারেন্ট জাল, মা-মাছ ও পোনা মাছসহ আহরণকারীকে আটক করা হয়ে থাকে। তারপরও যেন কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদ-নদীগুলো থেকে কমপক্ষে ৪০ প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত নদ-নদী খাল-বিলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে ডিম ছাড়ে। ডিম ফুটে যেসব রেণু বের হয় পরবর্তীতে সেগুলো বড় হয়ে প্রকৃতিতে মাছের ভারসাম্য রক্ষা করে। অথচ কৌশলে এসব ডিমওয়ালা মাছ ধরা হচ্ছে। আর যেগুলো রক্ষা পাচ্ছে সেসব মাছের ডিম ফুটে বের হওয়া রেণুও নতুনভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। রেণু সংগ্রহকারীরা এসময় নদ-নদী খাল-বিল থেকে রেণু পোনা সংগ্রহে নেমে পড়ে। রেণু পোনা সংগ্রহের জন্য পাতলা জাল, বেউচি জালসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল সংগৃহীত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনু থেকে শুধুমাত্র কাঙ্খিত মাছের রেণু পোনা আলাদা করে বাকি প্রজাতিগুলোর রেনু পোনা অযত্নে যেখানে সেখানে ফেলে দেয়ায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
মৎস্যজীবীরা জানান, ২০/২৫ বছর আগেও ঘোড়াঘাটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী গুলোর মধ্যে রয়েছে করতোয়া,যমুনেশ্বরী ও মোহনা নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। অথচ বছরের পর বছর ধরে ডিমওয়ালা মাছ ধরা ও রেনু পোনা নষ্ট করার কারণে এসব নদ-নদী থেকে দেশী মাছ সরপুঁটি, ভেদা, পাবদা, টেংরা, টাকি, পুটি, শিং, মাগুর, কৈ, খলিসা, বাউশ, কালবাউশ, ভেইশ, চাপিলাসহ কমপক্ষে ৪০ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ইতিমধ্যে সর্বত্রই ডিমওয়ালা মাছ ও রেনু পোনা শিকারীদের তৎপরতা চলছে। ডিমওয়ালা মাছ ও রেনু পোনা শিকারীরা উপজেলায় এদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। উপজেলার ,করতোয়া নদী তীরবর্তী মল্লিকপুর থেকে বালু পর্যন্তু এলাকা হতে ডিমওয়ালা মাছ ও রেণু পোনা সংগ্রহের কাজ চলছে। বিভিন্ন মৎস্য শিকারীরা প্রতি বছরই বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এসব এলাকা থেকে ডিম ওয়ালা মাছ ধরে হাট-বাজার গুলোতে বিক্রি করে থাকে।

মৎস্য বিভাগ বলছে,এখানের মিঠা পানির মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে নানা স্থানে রফতানি হয়। দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়াতে বিল খনন, মৎস্যজীবিদের প্রশিক্ষণ, বর্ষায় জলাশয়ে পোনা মাছ অবমুক্ত করা, কারেন্ট জাল প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিকারীদের হাত থেকে ডিমওয়ালা মাছ রক্ষাসহ নানাভাবে কাজ করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের পাশাপাশি পুকুরেও বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে। দেশীয় মাছের বংশ বিস্তারে নিময়নীতি অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

“ডিমওয়ালা মাছ ধরবেন না দেশের ক্ষতি করবেন না”এই শ্লোগান নিয়ে আমরা মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধের জন্য উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জেলেদের ও স্থানীয় সাধারণ লোকজনকে সচেতন করে যাচ্ছি। দেশীয় ডিম ওয়ালা মাছ রক্ষায় কোন আইন না থাকায় জেলেসহ সাধারন মানুষকে সচেতন করা ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের।দেশীয় মাছ রক্ষায় আইন করা জরুরী বলেও মনে করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।ডিম ওয়ালা মাছ ধরার ক্ষেত্রে ইলিশ মাছের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তবে দেশীয় মাছের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। আমাদের দেশীয় মাছ রক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর মা মাছ নিধন রোধে এবং সবাইকে সচেতন করতে মাইকিং করা হবে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর