মোঃ মাহফুজুর রহমান সরকার, ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ
দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ—এই চারটি উপজেলার কৃষিজমিতে দিন দিন বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা এখন জনস্বাস্থ্য, কৃষি অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য এক বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হয়ে থাকে। শুধু ঘোড়াঘাটেই প্রতি ডিলার বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার কীটনাশক বিক্রি করেন। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে সবজি বাগানে। স্থানীয় কৃষক মো. তকাব্বর হোসেন জানান, “ধানের ক্ষেত্রে প্রতি বিঘায় ২০০ গ্রাম এবং সবজিতে মৌসুমজুড়ে ২-৩ কেজি তরল কীটনাশক ব্যবহার করছি।” একই চিত্র দেখা গেছে অন্য কৃষকদের ক্ষেত্রেও।
কৃষকদের ভাষ্য মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, খরা বা কুয়াশায় ফসল রক্ষা করতে গিয়ে কীটনাশক কোম্পানির লোকদের পরামর্শেই অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক দ্রব্য। কৃষক মাহাবুর হোসেন বাবু বলেন, “আমরা অনেকে বুঝেও ভুল করি। কারণ কোম্পানির লোকজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, আর তারই পরিণতিতে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ হয়ে যায়।”
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, জমিতে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশকের একটি বড় অংশ থেকেই কিডনি, লিভার ও ক্যানসারজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় বাজারে পাওয়া ধনিয়া, বেগুন, ঢেঁড়শ, কুমড়া, পটলসহ অন্তত ৯টি সবজিতে বিষক্রিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
একাধিক কিডনি বিশেষজ্ঞ বলেন, “প্রতিদিনের খাদ্যের সঙ্গে আমরা আসলে বিষই খাচ্ছি। এসব শাকসবজি কোনো অপেক্ষামাণকাল না মেনেই বাজারজাত করা হয়।” ব্যবহারকৃত কীটনাশকের মধ্যে রিনকর্ড, সিমবুন, সুমিসাইডিন, হেপ্টাক্লোর, থায়াডিন, ডিডিটি-র মতো উচ্চমাত্রার বিষাক্ত উপাদান রয়েছে।
প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহারে শুধু মানুষের শরীরেই নয়, প্রভাব পড়ছে পরিবেশেও। বিলুপ্ত হচ্ছে পাখি ও উপকারী কীটপতঙ্গ। মাটি হারাচ্ছে স্বাভাবিক উর্বরতা। পরিবেশবিদদের মতে, “এসব রাসায়নিকের ব্যবহার কৃষিতে সাময়িক লাভ দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে।”
অপ্রাকৃতিক ঋতুতে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূলও এখন বাজারে। বৈজ্ঞানিক কৌশল ও কেমিক্যাল স্প্রের মাধ্যমে এখন বারো মাসই টমেটো চাষ সম্ভব হচ্ছে। ফল পাকানোর জন্য অতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে এসব ফসলের গায়ে উজ্জ্বল রঙ থাকলেও ভেতরে বিষক্রিয়ার মাত্রা বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, “আমরা নিয়মিত কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক সভা করি। আগের তুলনায় ব্যবহার কমেছে।” তবে বাস্তবে মাঠপর্যায়ে সেই সচেতনতা কার্যকর হচ্ছে না বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময়—সতর্ক হওয়ার, বিকল্প ও নিরাপদ কৃষি পদ্ধতিতে যাওয়ার। নয়তো কৃষি উৎপাদন টিকলেও, সমাজ ও প্রজন্মের স্বাস্থ্য থাকবে মারাত্মক হুমকির মুখে।