অভাগার কপালে চিন্তার ভাঁজ
মানুষ অভাগা জন্মায় না; তাকে অভাগা বানিয়ে রাখার জন্য সমাজ, রাষ্ট্র ও বাস্তবতার সমন্বিত অনীহাই যথেষ্ট।
“অভাগার কপালে চিন্তার ভাঁজ”—এই প্রবাদ বাংলায় বহুদিন ধরে প্রচলিত। যেন ভাগ্য এমন এক সর্বশক্তিমান সত্তা, যাকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, কারো জীবনে ভালো না চললে তা তার ‘অভাগা’ হওয়ার ফল। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এত সহজ? একজন মানুষের কঠোর পরিশ্রম, তার লড়াই, তার প্রতিদিনের সংগ্রাম—এসব কি কেবল ভাগ্যের কাছে হার মেনে যায়? নাকি এর পেছনে রয়েছে আমাদের সামাজিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, নীতি-নির্ধারণের দুর্বলতা এবং সুযোগের অসম বণ্টন?
এই দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে আমরা খুঁজে দেখব—অভাগা বলে পরিচিত মানুষগুলোর কপালে যে চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়, তা আসলে তাদের কর্মফলের হিসাব নয়; বরং সমাজের ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আজকের বাস্তবতায় ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আমরা অনেক সময় নিজেদের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করি। তাই প্রশ্ন জাগে—মানুষ সত্যি কি অভাগা হয়, নাকি আমরা তাকে অভাগা বানাই?
১. ভাগ্যের দায়ে সমাজের মুক্তি
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ‘ভাগ্যবাদ’ একটি প্রচলিত মানসিকতা। আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যেখানে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বাস্তব সমস্যাগুলো বাদ দিয়ে ভাগ্যকে সামনে আনা সবচেয়ে সহজ উপায়।
কেউ চাকরি না পেলে, কেউ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেলে তাকে বলা হয়—
“তোমার ভাগ্য খারাপ।”
কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে একটি নিষ্ঠুর সত্য—
সমাজ নিজের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যায়।
যে দেশে নীতি দুর্বল, শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর, কর্মসংস্থান সীমিত, সেখানে ব্যক্তির ব্যর্থতাটা তার ভাগ্যের নয়; বরং সেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতা।
প্রবাদটি তাই সমাজের ওপর একটি ঢাল তৈরি করেছে—
আমরা ব্যর্থ হলাম মানে আমাদের দোষ নয়, ভাগ্যের দোষ।
এটা হয়তো মানসিক সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু সমস্যার সমাধান করে না। সমস্যার মূলেই হাত না দিলে ‘অভাগা’ নামক আরেকটি প্রজন্ম আমাদের সামনেই জন্মাতে থাকবে।
২. পরিবার: তুলনার কারখানা, আশার নয়
পরিবার হলো মানুষের প্রথম সমাজ। সেখানে যদি বিশ্বাস, সমর্থন, বোঝাপড়া না থাকে, তাহলে মানুষ নিজেই নিজের শত্রু হয়ে ওঠে। আমাদের পরিবারে একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে—
তুলনা।
-
“দেখো, ওর ছেলে এত ভালো চাকরি পেল, তুমি পারলে না কেন?”
-
“ওর মেয়ে বিদেশে পড়তে গেল, তুমি তো ভাগ্যহীন।”
-
“তোমাকে কত পড়াশোনা করালাম, শেষমেষ কি হলে?”
এই কথাগুলো হয়তো অভিভাবকরা বলেন ভালো চেয়ে; কিন্তু বাস্তবে এগুলো একটি সন্তানকে নিজের প্রতি অবিশ্বাসী করে তোলে। চেষ্টা যেন মূল্যহীন হয়ে যায়, ফলাফলের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু ভাগ্যের অভিযোগ।
ফলে সমাজে এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা নিজের সমস্যা বোঝার আগে নিজেকে দোষারোপ করে। অথচ সে যে কতটা চেষ্টা করেছে—তা দেখার মানুষ খুব কমই আছে।
পরিবারে এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি একজন সুস্থ মনের মানুষকেও অভাগা হিসেবে অনুভব করাতে পারে।
৩. শিক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর—ভাগ্যের জন্মস্থান
একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার শিক্ষায়।
কিন্তু আমরা একটি পরীক্ষানির্ভর শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি যেখানে—
-
সৃজনশীলতা নেই,
-
বাস্তব দক্ষতা নেই,
-
চাকরি বাজারের চাহিদা নেই,
-
উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি নেই।
ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিযোগিতা করে শুধু নম্বরের জন্য, দক্ষতার জন্য নয়। ফলে একজন ছাত্র ভালো নম্বর পেলেই সে ‘সৌভাগ্যবান’; আর কেউ পিছিয়ে গেলে সে ‘অভাগা’। অথচ বাস্তবে নম্বর কোনো মানুষের প্রকৃত যোগ্যতার মানদণ্ড নয়।
একজন ছাত্র যখন চার বছর পড়ে বের হয়, তখন সে জানতে পারে—
-
চাকরির সুযোগ সীমিত
-
প্রতিষ্ঠানগুলো অভিজ্ঞতা চায়
-
আর অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না
-
দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করতে তাকে আবার নতুন প্রশিক্ষণ নিতে হয়
-
চাকরি না পেলে তাকে বলা হয়, “তোমার ভাগ্য ভালো না”
এখানে ব্যর্থ হলো কে?
ছাত্র? নাকি শিক্ষা ব্যবস্থা?
৪. কর্মসংস্থানের সংকট—ভাগ্য নয়, নীতির ব্যর্থতা
ধরা যাক, একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কর্মসংস্থানের আশায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছেন। তিনি প্রতিভাবান, দক্ষ, পরিশ্রমী। কিন্তু—
-
চাকরির বাজার সংকুচিত
-
নতুন প্রতিষ্ঠান কম
-
পুরনো প্রতিষ্ঠানে পদ খালি হয় অল্প
-
বেতনের পরিমাণ জীবনযাপনের তুলনায় কম
-
দক্ষতার প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত
ফলে তিনি হতাশ হন। পরিবার, সমাজ তাকে ‘অভাগা’ বলে দায় এড়াতে শুরু করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—
তাকে অভাগা বানালো কে?
অন্যায় নীতি, অদক্ষ পরিকল্পনা ও সঠিক কর্মসংস্থান তৈরির ব্যর্থতাই তাকে এই অবস্থায় আনল। ভাগ্য তার দোষী নয়।
৫. দ্রব্যমূল্যের আগুন—চিন্তার ভাঁজের প্রকৃত কারণ
বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো বাজার। প্রতিদিন দাম বাড়ছে—
-
চাল
-
ডাল
-
তেল
-
সবজি
-
মাংস
-
ওষুধ
-
শিক্ষার খরচ
-
বাসা ভাড়া
মধ্যবিত্তের আয় বাড়ে না, কিন্তু ব্যয় বাড়তে থাকে। ফলে মাসের শেষ দিকে মানুষ হিসাব মেলাতে গিয়ে ভেঙে পড়ে। তখনই সমাজ বলে—
“অভাগার কপালে সুখ জোটে না।”
কিন্তু যারা রাতদিন পরিশ্রম করেও সংসার চালাতে পারে না, তারা কীভাবে অভাগা হয়?
এটা রাষ্ট্রীয় নীতির সংকট, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব—এগুলোই প্রকৃত অপরাধী।
৬. কৃষক: দেশের খাদ্যদাতা, সমাজের অভাগা?
বাংলাদেশের কৃষক বছরজুড়ে কষ্ট করে খাদ্য উৎপাদন করেন। কিন্তু—
-
তিনি ন্যায্য দাম পান না
-
তাঁকে ধানের নীচে, চাষের ঋণের নীচে চাপা পড়ে বাঁচতে হয়
-
কখনো কখনো ধান পোড়াতে হয় উৎপাদন খরচ না উঠায়
-
আর তখন তাকে বলা হয় ‘অভাগা কৃষক’
দেশের সবচেয়ে মহৎ পেশাগুলোর একটি আজ ভাগ্যের কাছে পরাজিত নয়—নীতির কাছে পরাজিত।
কৃষক যদি সরকারিভাবে সঠিক সহায়তা পেত, বাজারের হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ হতো, তাহলে এই ‘অভাগা’ শব্দটি তার সাথে মানাত?
৭. সমাজে বৈষম্য—অভাগা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ
যখন একটি সমাজে—
-
কেউ অযথা বিলাসিতা করে
-
কেউ রাস্তায় ঘুমায়
-
কেউ ব্যাংকে কোটি টাকা লোন পেয়ে মাফ পায়
-
আর কেউ ৫০,০০০ টাকার লোন শোধ করতে হিমশিম খায়
তখন সেখানে ‘অভাগা’ মানুষ বাড়বেই।
বৈষম্যের এই বাস্তবতা মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে—
প্রভাবশালী এবং অথর্ব।
এখানে ভাগ্যের ভূমিকা খুবই কম;
বাস্তবতা হলো—
সুযোগ যার কাছে গেছে, সে এগিয়েছে;
যার কাছে যায়নি, সে পিছিয়ে পড়েছে।
৮. আমাদের মানসিকতা—নিজের দোষ ঢাকতে ভাগ্যের ওপর দোষ চাপানো
সত্যিকারের সমস্যা হলো এই মানসিকতা।
আমরা খুঁজে দেখি না—
-
সমস্যার মূল কোথায়
-
সমাধান কী
-
নীতিতে কী পরিবর্তন দরকার
-
সমাজ কী করতে পারে
-
পরিবার কিভাবে সহায়তা দিতে পারে
বরং অতি সহজ ব্যাখ্যা—
“ভাগ্য খারাপ।”
এটি মানুষকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
সে মনে করে—
“যাই করি, কিছু হবে না।”
এভাবে তার চিন্তার ভাঁজ বাড়তে থাকে, আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে।
৯. অভাগা নয়—অসম সুযোগের শিকার
যে মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মায়
যার শিক্ষার সুযোগ নেই
যার সামান্য চিকিৎসার টাকা নেই
যার চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই
যে দুর্নীতির কারণে পদ হারায়
যে সম্পর্কের কারণে পিছিয়ে পড়ে
যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে
যে নিয়মতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলার শিকার হয়
তাকে আমরা ‘অভাগা’ বলি।
কিন্তু সে আসলে অভাগা নয়।
সে একটি ভাঙা সিস্টেমের শিকার।
১০. সত্যিকারের সমস্যা: দায় স্বীকার না করা
যখন আমরা একজনের ব্যর্থতাকে ভাগ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করি, তখন আমরা:
-
সমস্যাকে আড়াল করি
-
দায়িত্ব এড়াই
-
রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকি
-
সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যাই
-
মানুষকে ভুল পথ দেখাই
-
পরিবর্তনের সুযোগ নষ্ট করি
ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই চক্রে ঘুরে বেড়ায়।
১১. কীভাবে বদলানো যায় মানুষের ভাগ্য?
১) সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা
দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও বাস্তব প্রশিক্ষণভিত্তিক শিক্ষা।
২) কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
নতুন শিল্প, উদ্যোক্তা সহায়তা, স্টার্টআপ নীতি।
৩) কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত
সরাসরি ক্রয়, বাজার নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি সহায়তা।
৪) সুশাসন প্রতিষ্ঠা
দুর্নীতি কমলে রাষ্ট্র নিজেই উন্নত হয়।
৫) পরিবারে সহনশীলতা
তুলনা নয়—উৎসাহ।
৬) মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
চাপ কমানো, পরামর্শ কেন্দ্র।
৭) সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত
সবার সমান সুযোগ।
১২. একটি প্রশ্ন: সত্যিই কি অভাগা বলে কেউ আছে?
মানুষ জন্মায়—
-
স্বপ্ন নিয়ে
-
সম্ভাবনা নিয়ে
-
প্রতিভা নিয়ে
-
ইচ্ছাশক্তি নিয়ে
-
চেষ্টা করার গভীর তাগিদ নিয়ে
কিন্তু সে বড় হয়—
-
অসম সুযোগে
-
ভুল নীতিতে
-
দারিদ্র্যে
-
বৈষম্যে
-
ক্ষোভে
-
ভয়ে
-
পরিবার ও সমাজের চাপের মধ্যে
ফলে তার প্রতিভা প্রকাশের আগেই হতাশা তাকে গ্রাস করে।
তাহলে সে অভাগা?
না।
সে একটি অন্যায় ব্যবস্থার শিকার।
১৩. অভাগার কপালে যে চিন্তার ভাঁজ—তা আসলে আমাদের ব্যর্থতার দাগ
এই ভাঁজগুলো—
-
ক্ষুধার ভাঁজ
-
অসমতার ভাঁজ
-
দারিদ্র্যের ভাঁজ
-
নীতির ত্রুটির ভাঁজ
-
সমাজের অবহেলার ভাঁজ
-
পরিবারের ভুল ধারণার ভাঁজ
একজন মানুষকে ভেঙে দেয়, ক্ষয়ে দেয়।
কিন্তু তাকে আমরা বলি অভাগা।
সমাপনী: অভাগা নয়—আশার মানুষ
মানুষ অভাগা নয়।
মানুষ সংগ্রামী।
সে হাল ছাড়ে না।
পরিবর্তন চায়।
স্বপ্ন দেখে।
পরিশ্রম করে।
লড়াই করে।
ভালো চায়।
তার কপালে যে চিন্তার ভাঁজ,
তা হতাশার প্রতীক নয়—
বরং নতুন লড়াইয়ের প্রস্তুতির প্রতিচ্ছবি।
দিনশেষে ভাগ্যকে দোষারোপ একটি সহজ উপায়, কিন্তু সমাধান নয়।
সমাধান হলো—
-
দায়িত্ব নেওয়া
-
সঠিক নীতি তৈরি
-
পরিবারের সমর্থন
-
সমাজের সহানুভূতি
-
মানুষের প্রতি বিশ্বাস
-
ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা
তখন আর কারো কপালে অভাগা হওয়ার ভাঁজ থাকবে না।
সাম্প্রতিক মন্তব্য
কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য লিখুন