পঞ্চগড়ে ভ্যানচালকের মেয়ে সোনালী এখন জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক

“আমি ভ্যান চালাই, আমার মেয়ে বিমানে চড়ে দেশ–বিদেশে খেলতে যায়”—আবেগ আর গর্বে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে ফারুক ইসলামের। প্রত্যন্ত গ্রামের এই ভ্যানচালকের মেয়ে ফেরদৌসি আক্তার সোনালী এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক। অভাব, কষ্ট আর চারপাশের তির্যক দৃষ্টি জয় করে সোনালী আজ স্বপ্নের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে।
সোনালীর বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বনগ্রামে। বাবা ফারুক ইসলাম জীবিকা নির্বাহ করেন ব্যাটারি চালিত ভ্যান চালিয়ে, মা মেরিনা বেগম গৃহিণী। সংসারের সম্পদ বলতে ভিটেবাড়ির সাত শতক জমি। অভাব–অনটনের সংসারে তিন সন্তানের মধ্যে সোনালী বড়।
শৈশব থেকেই তার ঝোঁক ছিল খেলাধুলার প্রতি। তবে গ্রামের মানুষজনের চোখে মেয়েদের মাঠে নামা মানেই ‘কটূ মন্তব্য’ ও বাঁকা দৃষ্টি। অনেকে বলতো, “মেয়ে হয়ে আবার ফুটবল খেলে নাকি!” তবুও দমে যাননি সোনালী।
স্থানীয় গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সোনালীর। সেখানকার ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তার অসাধারণ পারফরম্যান্স সবার নজর কাড়ে। পরবর্তীতে হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে স্কুল টিমের হয়ে খেলেন আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে। এখান থেকেই শুরু হয় তার নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন।
পঞ্চগড় শহরের টুকু ফুটবল একাডেমি তখন স্থানীয় প্রতিভা গড়ে তোলার কাজ করছিল। একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন—
“সোনালী খুবই সম্ভাবনাময়ী ছিল। প্রচণ্ড কষ্ট করে প্রতিদিন অনুশীলনে আসতো। তার চোখেমুখে সবসময় বড় স্বপ্ন দেখতাম। আমি জানতাম, সে একদিন অনেক দূর যাবে।”
গ্রামে অনেকেই বলতো, “মেয়ে কি ফুটবল খেলবে? সংসারে খাওয়ার কষ্ট, মেয়েকে খেলাধুলায় পাঠানোর কী দরকার?” মাঝে মাঝে বাবা–মাও নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু সোনালী শুনতেন না। টুকু একাডেমিতে অনুশীলন করতে যেতেন খেয়ে–না খেয়ে, কখনো ধার করা টাকায়।
বাবা ফারুক ইসলাম বলেন—“অনেক সময় মেয়েকে বলতাম, সংসারে সাহায্য করো। কিন্তু সে একরোখা, বলতো ফুটবলই খেলবে। আমি বড় কোনো সহায়তা করতে পারিনি, কিন্তু কখনো তাকে বাঁধাও দেইনি।”
মা মেরিনা বেগম বলেন—“অনেক সময় টাকার অভাবে অনুশীলনে যাওয়া হয়নি। তবুও মেয়ে হাল ছাড়েনি। ঘরে সবার আগে তার স্বপ্নটাই বড় ছিল।”
২০২৩ সালে তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। বর্তমানে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়ছেন এবং গোলরক্ষক হিসেবে কঠোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখান থেকেই শুরু হয় জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার পথচলা।
সোনালীর ফুটবল জীবন ইতিমধ্যে সাফল্যে ভরপুর— বিকেএসপিতে পড়াকালীন জাতীয় নারী ফুটবল দলে ডাক পান। সিনিয়র দলের হয়ে জর্ডানে খেলতে যান। সেখানে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হয়। অনূর্ধ্ব–২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেন। সম্প্রতি লাওসে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব–২০ নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে রানার্সআপ হন।
এবার লাওস থেকে দেশে ফিরেই ছুটে আসেন জন্মভিটায়। ঢাকা থেকে পঞ্চগড় পৌঁছে বাবার ভ্যানেই ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যান। সোনালীকে বাড়িতে পেয়ে গ্রামের মানুষ ভিড় জমায়, মিষ্টি বিতরণ করেন বাবা।
বাবা ফারুক ইসলাম বলেন—“আজ আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে, দেশের হয়ে বিদেশে যাচ্ছে। আমি গরীব মানুষ, কিন্তু আমার মেয়ে আমার মুখ উজ্জ্বল করেছে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই।”
মা মেরিনা বেগমের চোখে পানি—“আমাদের অনেক অভাব ছিল, তবুও মেয়ে হাল ছাড়েনি। আজ জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে—আমি বিশ্বাস করি, একদিন দেশের জন্য আরও বড় কিছু করবে।”
হাড়িভাসা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন—
“অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সোনালী আমাদের ইউনিয়নের গর্ব। তার সাফল্য যেন অন্য মেয়েদেরও অনুপ্রেরণা হয়। প্রশাসনের উচিত তার পরিবারকে সহায়তা করা।”
জাতীয় নারী ফুটবল দলের আরেক গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমের বাড়িও একই ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তিনিও টুকু ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করেছেন। ফলে এক ইউনিয়নের দুই কন্যা এখন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেশের হয়ে খেলছেন।
সোনালী বলেন—“আমি চাই দেশের জন্য বড় কিছু করতে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভালো খেলতে পারলে দেশের নাম আরও উজ্জ্বল হবে।”
তার চোখে এখন বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। বাবার ভ্যান থেকে বিমানে ওঠার যে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটি যেন থেমে না যায়—এটাই তার প্রার্থনা।
সাম্প্রতিক মন্তব্য
কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য লিখুন